সমবায় অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী বাবলা দাস গুপ্ত এখন জিনের বাদশা, বিদেশে পাচার করেছেন শতকোটি টাকা

প্রকাশিত: ১:৫৫ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৩, ২০২৩

রিপোর্টিং,বিশেষ প্রতিনিধি : সরকারি চাকরিতে ২৬ বছর চলছে। বড় কোনো কর্মকর্তা নন। অফিস সহকারী পদে চাকরি জীবন শুরু। পদোন্নতি পেয়ে এখন উচ্চমান সহকারী। তবে সমবায় অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবলা দাস গুপ্তের জীবনের চাকচিক্য সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।

দুর্নীতি,নিয়োগ বাণিজ্য ও অর্থলোপাট করে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বাবলা। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগও আছে। আত্মীয়-স্বজনসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে সরকারি চাকরি দিয়েছেন। দুর্নীতি করে ঢাকা,চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বিদেশে গড়েছেন বিপুল ধনসম্পদ।

১৯৯৬ সালে অফিস সহকারী হিসেবে সমবায় অধিদপ্তরে চাকরি শুরু হয় বাবলা দাসের। ২০০৯ সালে পদোন্নতি পেয়ে উচ্চমান সহকারী হন। বর্তমানে সমবায় অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত বাবলার হাতে যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’।

জানা গেছে,সমবায়ে বাবলার ক্ষমতার দাপটে তটস্থ থাকেন অফিসের সবাই। যারাই তার বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদেরকে যেখানে-সেখানে বদলি করে দেন। কিন্তু তিনি নিজে সমবায় অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ছাড়েননি।

কারণ,সমবায় অধিদপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্য,পদোন্নতি,পোস্টিং,ডাম্প পোস্টিং,শাস্তি প্রদানের নিয়ন্ত্রণ অলিখিতভাবে তার হাতে। তাছাড়া নতুন নিবন্ধন,নিবন্ধিত সমবায়ের নবায়ন,অডিট,পরিদর্শন,সমিতিগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠান,পাতানো নির্বাচন দেখিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাতে সমিতি কুক্ষিগত করে রাখায় সহযোগিতাসহ বিশেষ কর্মগুলো তাকে ছাড়া প্রায় অসম্ভব।

বাবলা দাসের গুপ্তধনের সন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে বাবলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। যদিও মহাপরিচালক (ডিজি) তরুণ কান্তি শিকদারের দাবি, বাবলা দাসের অতো ক্ষমতা নেই। বাবলার বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ পাননি বলেও দাবি তার।

তবে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক ড. তরুণ কান্তি শিকদার সাপ্তাহিক রিপোর্ঢিং এর নিকট স্বীকার করছেন,দীর্ঘদিন ধরে বাবলা সমবায়ে কর্মরত এবং তার পরিবারের পাঁচজন সমবায় অধিদপ্তরে চাকরি করেন। তবে তাদের যোগ্যতা আছে বলেই তারা এখানে চাকরি পেয়েছেন।

জানা গেছে,বাবলা দাসের ছোট ভাই, বৌদি, স্ত্রী ছাড়াও পরিবারের সদস্য,আত্মীয়-স্বজন,দূর সম্পর্কের ভাই-ভাগ্নি, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন, হাউজ টিউটরকেও বিমুখ করেননি। অভিযোগ আছে, অধিদপ্তরে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় মেধাবীরা টিকলেও পরবর্তীতে ঘুষ না দেয়ায় তাদেরকে বাতিল বলে গণ্য করা হয়। পরে বাবলার লোকজনকে অর্থের বিনিময়ে চাকরিতে ঢোকানো হয়।

এভাবে দূর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে বাবলা দাস করেছেন বিপুল ফ্ল্যাট, প্লট ও বাড়ি। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশেও গড়েছেন ধনসম্পদ। সেখানেও প্রায় আসা যাওয়া আছে তার।

২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক (বর্তমানে অতিরিক্ত নিবন্ধক, সমিতি ব্যবস্থাপনা) আহসান কবীর স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বাবলা দাস গুপ্তকে কক্সবাজার বদলি করেন।

সেখানে বলা হয়,উচ্চমান সহকারী বাবলা দাস গুপ্তকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা সমবায় কার্যালয়ের প্রধান সহকারী পদে বদলি করা হলো। চিঠিতে আরও বলা হয়, ১৩ সেপ্টেম্বর পূর্বাহ্নে তাকে এ দপ্তর থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অবমুক্ত করা হলো। কিন্তু এই আদেশের পরেও বাবলা দাস ঢাকা ছাড়েননি।

এদিকে বাবলার ছেলে শৈবাল দাস শুভ ভারতের কলকাতায় থেকেই পড়াশোনা করেন। সেখানে বাবলার ফ্ল্যাট, প্লট ও বাড়ি রয়েছে। দেশটিতে নিজের গড়া একটি ফ্ল্যাটে থেকে পড়াশোনা করে বাবলার ছেলে শুভ।

বাবলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে ও ছিল এমন কোনো প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় ফেল করেন না। এজন্য বাবলার আছে কৌশল। সমবায় অধিদপ্তরে অনেক পরিবার আছে যারা বাবলা মাধ্যমে চাকরি নিয়েছেন পরে এই পরিবারগুলোর পাঁচ-ছয়জন সদস্য চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। যাদের নামের শেষে ‘দাস, ‘গুপ্ত’ ‘দেব’ কিংবা ‘নন্দী’ রয়েছে তারা কোনো না কোনোভাবে বাবলা দাসেরই আত্মীয়-স্বজন।

বাবলা যাদের চাকরি দেন তাদের লিখিত পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়ার নিশ্চয়তা দেন। অভিযোগ আছে, আত্মীয়-স্বজন লিখিত পরীক্ষায় পাস না করলেও তাদের উত্তরপত্র কৌশলে গায়েব করে দেন বাবলা। পরে নিজের বাসায় প্রার্থীকে বসিয়ে খাতা পূরণ করে সেটি যথাস্থানে পৌঁছে দেন। ফলে বাবলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় ফেল করেন না।

২০১২ সালে লিখিত পরীক্ষায় ‘পাস’ দেখিয়ে চাকরি দেন অন্তত ৩৩ জনকে। এদের মধ্যে প্রশিক্ষক লাবনী চৌধুরী, ইন্সপেক্টর শ্রাবন্তী দাস গুপ্ত, মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন, ইকবাল হোসাইন, সরেজমিন তদন্তকারী মোহাম্মদ মহসিন ইসলাম, ইন্সপেক্টর শাপলা প্রভা দে, অজুতা খাতুন, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, সরেজমিন তদন্তকারী সাফিনা রুবি, ইন্সপেক্টর সুমা রায়, কল্পিতা ভৌমিক, প্রমিলা রানী রায়, রিজোয়ানা ইসলাম, মোহাম্মদ রবিউল করিম, সরেজমিন তদন্তকারী মোহাম্মদ আতাউর রহমান, ইন্সপেক্টর পপি রানী, তাপস কুমার সরকার, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, সরেজমিন তদন্তকারী মোহাম্মদ আজাদুল ইসলাম, ইন্সপেক্টর নাসিমুল হক, মো. আবুল হোসাইন, মো. ইসমাইল হোসেন, জাহাঙ্গীর হোসেন, শিপ্রা দেবনাথ, আসলাম কবির, সরেজমিন তদন্তকারী পলাশ সাহা, ইন্সপেক্টর সরোয়ার জাহান, উম্মেল কুলসুম সনিয়া, অভিজিত দাস চৌধুরী, রাজীব কান্তি দেব ও আয়েশা বেগম চৌধুরী রয়েছেন।

দেশ-বিদেশে বাবলার আছে বিপুল সম্পদ। কক্সবাজার উখিয়ায় কিনেছেন প্রচুর জায়গা-সম্পত্তি। সেখানে মার্কেট সমেত একটি বাড়ি রয়েছে তার। চট্টগ্রাম শহরের আসকার দীঘিরপাড় এলাকায় (আনসার-ভিডিপি অফিসের পার্শ্ববর্তী গলিতে অবস্থিত) আছে ফ্ল্যাট। চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় গুডস হিলের দক্ষিণে দ্বিতীয় স্ত্রী জয়শ্রী দাসকে কিনে দিয়েছেন ফ্ল্যাট। আগের ঘরের সন্তানসহ জয়শ্রী বসবাস করেন এই ফ্ল্যাটে। বাবলা শুক্র-শনিবার বিমানযোগে চট্টগ্রাম গেলে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন।

২০১৪ সালে চট্টগ্রাম কর্ণফুলী থানার চর পাথরঘাটা এলাকায় কেনেন প্লট। এছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে মা, ভাই ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে কিনেছেন একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও বাড়ি। কক্সবাজার উখিয়ার উয়ালাপালং মৌজায় ২০১৪ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি কেনেন একটি প্লট (উখিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিস, দলিল নং-২৯৪/১৪)। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে তখন তার চাকরির বয়স ৭-৮ বছর। ওই সময় ১৮ লাখ টাকায় নিজ নামে কেনেন প্লটটি। যদিও এর স্থানীয় প্রকৃত মূল্য চার গুণ বেশি। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে মা, ছেলে, জয়শ্রীর নামে রয়েছে এক ডজনের বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। এসবে ঘুষের টাকা গচ্ছিত রাখেন।

গত ১৬ জানুয়ারি সমবায় অধিদপ্তরে বিভিন্ন ক্যাটাগরির আড়াইশ জনের পদোন্নতির পরীক্ষা হয়। পদোন্নতির আশ্বাস দিয়ে বাবলা চারকোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। লেনদেনের বিষয়টি টের পেয়ে পদোন্নতি বোর্ড মাত্র একজনকে উত্তীর্ণ করে।

এছাড়াও বদলি করে দেয়া হয় বাবলার সিন্ডিকেটভুক্ত সমবায় কর্মকর্তাদেরও। একারণে আপাতত ভেস্তে গেছে বাবলার পদোন্নতি বাণিজ্য পরিকল্পনা। গুঞ্জন রয়েছে, ওই পদোন্নতি কমিটি ও পদস্থ কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করতে বাবলার বাজেট ছিল ৩৬ লাখ টাকা। বাকি টাকা পকেটে ঢুকাতেন নিজেই।

সাপ্তাহিক রিপোর্টিং টিম বাবলা দাস গুপ্তের খোঁজে সমবায় অধিদপ্তরে গিয়ে সমবায় ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সপ্তম তালা পর্যন্ত হন্যে হয়ে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। অফিসের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী রহস্য জনক কারনে বাবলা দাস গুপ্তের কোন বসার স্থান বা রুম দেখিয়ে দিতে পারেননি প্রায় ৪৫ মিনিট পর খোঁজ মিলে তালাবদ্ধ প্রশাসনিক কর্মকর্তার রুম। তাহার ব্যবহৃত মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

নাম না প্রকাশের শর্তে এক কর্মচারী বলেন বাবলা দাস গুপ্ত এখন জীনের বাদশাহ হয়ে গিয়েছে,সকালে অফিসে এসে আত্মগোপনে চলে যায়। ছুটির পর বিকেলে বেরিয়ে আসে।

বাবলা দাশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বর্তমানে তদন্ত করছে দুদক। ১৬ জানুয়ারি বাবলা দাসকে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। সংস্থাটির উপ-সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান ভুইয়া রিপোর্ঢিংকে বলেন,‘আমরা তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তার বিষয়ে আমরা আরও খোঁজ খবর নিচ্ছি।’

দুর্নীতি অনিময়ের এতো অভিযোগের পর বাবলা দাস গুপ্তকে নিয়ে কী ভাবছে সমবায় অধিদপ্তর? জানতে চাইলে সংস্থাটির নিবন্ধক ও মহাপরিচালক ড. তরুণ কান্তি শিকদার রিপোর্ঢিংকে বলেন, ‘এখনো কেউ তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তিনি অনেককে চাকরি দিয়েছে এটা সম্পূর্ণ সত্য না। তিনি (বাবলা)কাউকে চাকরি দিতে পারেন না। হয়ত অনেক দিন চাকরি করেন, তাই কারও জন্য তদবির করেছেন। বাবলার আত্মীয়-স্বজন অনেকেই সমবায় অধিদপ্তরে কর্মরত, এ বিষয়ে তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, ‘পাঁচজন চাকরি করে। তবে তারা তাদের মেধা আছে বলেই চাকরিতে ঢুকেছে। আর সে সময় যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কী করেছেন আমি জানি না।

বাবলা দাস গুপ্ত একজন উচ্চমান সহকারী মাত্র। অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে নিয়োগ.পদায়ণ ও বদলি বাণিজ্যে তার এমন প্রভাবের নেপথ্য শক্তি কে বা কারা, তা খুঁজে বের করা জরুরি।

সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. তরুন কান্তি শিকদার, সমবায় উপমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সচিব মশিউর রহমানসহ সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার দায় এড়াতে পারেন না। বাবলা দাস গুপ্তের মত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সরকারী অফিসে দূর্নীতি-লুটপাটের আখড়া খুলে বসেছেন। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। দুদকের নাম কা ওয়াস্তে অনুসন্ধানের পর দায়মুক্তির ধারাক্রম বন্ধ করতে না পারলে সরকারি অফিস ও প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতি,অর্থ-লুটপাট ও পাচার বন্ধ করা অসম্ভব।

দেশের মেধাবি তরুণরা ভাল ফলাফলসহ উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট নিয়েও যখন চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে, তখন বাবলা দাশ গুপ্তরা অন্ধকার পথে শত শত নিকটাত্মীয় ও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অযোগ্য, অদক্ষদের সরকারি দফতরে চাকরি দিয়ে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছেন। সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে হলে এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাবলা দাশ গুপ্তের নামে বেনামে আত্মীয় স্বজনের অবৈধ আর্থিক লেনদেনের ব্যাংক হিসাব সমুহের খতিয়ান সমুহ তুলে ধরা হবে রিপোর্টিং এর আগামী সংখ্যায়। চলবে………………………………………