তর্কে বিধায়ক না তত্বাবধায়ক

প্রকাশিত: ১২:৪০ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১, ২০২৩

রিপোর্টিং,বেদুইন হায়দার লিও : ইতিহাস এমন একটি অধ্যায় যেটা অস্বীকার করা কঠিন। আজ আমাদের গোটা জাতি একটি কঠিন প্রশ্নের সামনে বা একটি সহজ প্রশ্নের কঠিন উত্তর কি হতে পারে আগামীতে। কেমন হবে আগামী নির্বাচন। কি হবে সেটা বলা কঠিন এবং উত্তরের জন্য হয়তো আপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কেন এমন হলো কার দায়ই বা কত সেটার একটা ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা থাকা বা দেওয়া দরকার। ইতিহাসের কতটুকু দায় আওয়ামী লীগের কতটুকু দায় সেনা ছাওনি তে জন্ম নেওয়া দল বিএনপির।

সবাই জানে কিন্তু একটি বিশ্লেষণ।

উনিশ’শ নব্বই সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের বা তৎকালিন কথিত নির্বাচিত জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর চারটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে একবার বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে বারবার ক্ষমতায় পালাবদল হয়েছে। উনিশ’শ একানব্বই সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোন একটি দল পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। পরাজিত দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এসব নির্বাচনের ফলাফল দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।

১৯৯১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সে ধরণের সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অংশ ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সাল থেকে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলে ধরে এক যোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে, যেটা সকল বিরোধী দল শুধু বর্জন নয়, ব্যাপক বিক্ষোভের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। বিতর্কিত এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ২৬শে মার্চ তৎকালীন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।

নির্বাচনে পরাজিত দল বিএনপি নির্বাচনে ‘পুকুর চুরির’ অভিযোগ আনলেও, তাদের সেই দাবি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে কোন রকম ঝামেলা ছাড়ায় নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে। সে নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী জোট ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে পক্ষপাতিত্ব এবং কারচুপির অভিযোগ আনে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেটি হালে পানি পায়নি ২০০১ সালের সে নির্বাচনও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এরপর থেকে শুরু হলো ঐতিহাসিক বিপত্তি।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরেই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সংবিধানে সংশোধনের কয়েকটি দিক ছিল।এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫টি করা হয়েছিল।

এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেবার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়েছিল।

সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ছবি প্রদর্শনের বিধানও করা হয়েছিল এর মাধ্যমে। ২০০৪ সালের ১৬ই মে সংসদে এই সংশোধনীর জন্য বিল উত্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ। যার মধ্যে সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানো। সংবিধানের এই সংশোধনী একেবারেই সাদামাটা কোন বিষয় ছিল না।এর পেছনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ইচ্ছে লুকায়িত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। এবং এর পিছনে যে রাজনীতি থাকবে সেটা পরে জানা যায়। কারণ, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ছিল। সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে যে, বিএনপি তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করার জন্য নানা আয়োজন করেছে।

২০০৩ সালের জুন মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, বিএনপি সরকারের পছন্দের কারণেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে মি. হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল । আইন বিষয়ক প্রয়াত লেখক এবং সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ২০১৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে এক নিবন্ধে লিখেছেন, “হাসানকে যখন ১৩ তম প্রধান বিচারপতি করা হয় তখন ওই দুজনকে ডিঙিয়ে তা করা হয়। সেই অর্থে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পথ বিএনপিই দেখিয়েছে।’ প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন তত্বাবধায়ক ব্যাবস্থাকে প্রথম প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল বিএনপিই। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স-সীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান অবসরের পরপরই যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন।

বিচারপতি কেএম হাসান যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন সেজন্য ২০০৪ সাল থেকেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করতে থাকে। তারা শুরু থেকেই বলতে থাকে যে, কেএম হাসান ‘বিএনপির লোক’ এবং এক সময় তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি বিএনপির কমিটিতেও ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়।

আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই বলে আসছিল যে, তারা কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে মানবে না। অন্যদিকে বিএনপিও তাদের পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে যাচ্ছিল। কারণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ ছিল বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে। তারা বুঝতে পারছিলেন যে, ২০০৭ সালের নির্বাচনে তাদের পক্ষে জয়লাভ করা সহজ হবেনা। তাছাড়া, ১৯৯১ সাল থেকে দেখা গেছে যে, কোন সরকার পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। সব মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের কব্জায় রাখার কৌশল বের করে বিএনপি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ এটা ঠিক যে বিএনপি নির্বাচন ম্যানিপুলেট করতে চেয়েছিল, বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে তাদের পছন্দের লোককে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য। ” আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলনের মুখে বিচারপতি কেএম হাসান ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মি. হাসান তখন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ ভেঙে যাওয়ায় তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান থেকেই বাতিল করে দেয়। এ বাতিলের প্রক্রিয়াও ছিল অন্য রকম, যেটি খুবই নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা হয়। প্রক্রিয়াটি ছিল এমন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটের ফলে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ ঘোষণা করে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে রিট ও শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এরপর ওই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের বিধান রেখে সংবিধান সংশোধন বিল পাস হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের নির্বাচন। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতায় রয়ে গেছে আওয়ামী লীগ।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন অসাংবিধানিক এবং এ ইস্যুতে অতীতের মতোই বিপরীতমুখী অবস্থানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সরকার বলছে, ভোট হবে সাংবিধানিক বিধানমতেই। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু বহুদূরে চলে গেছে, তা ফিরে আসবে না কোনোভাবে। সরকারের বক্তব্য হলো দেশের সর্বশেষ রায়দাতা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বাতিল হয়েছে এ ব্যবস্থা এবং আইন প্রণয়নের সুপ্রিম প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদও সেই রায়ের আলোকে এটি বাতিল করে দিয়েছে। এখন কোনো সুযোগই নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরার।

তবে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পঙক্তি টি হতে পারে ” মানুষ এসেছে গ্রন্থ কিতাব গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন “।

ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিএনপি দুই বার ক্ষমতায় থেকে তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাচন ব্যাবস্থাকে বির্তকিত করেছে এবং আওয়ামী লীগে ২০০১ সালে সাধারণ ভাবে চলে গেছে আর পরবর্তীতে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে তত্ত্বাবধায়ক বাতির করে।

দিন শেষে হয়তো জনগন সিদ্ধান্ত নিবে যেভাবে নিয়েছিল ৭০ এ।

-বেদুইন হায়দার লিও

কেন্দ্রীয় কার্য্যনির্বাহী সদস্য
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট।