পাসপোর্টে ভুলের দায় নিতে নারাজ কর্তারা

প্রকাশিত: ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১, ২০২৩

রিপোর্টিং : আকাশ রাজী পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তিনি নতুন করে পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য নিয়ম অনুযায়ী ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন। পরে ছবি তোলার নির্ধারিত সময় গত ২৭ মার্চ আগের পাসপোর্ট (এমআরপি) নিয়ে উপস্থিত হন পাসপোর্ট অফিসে। কিন্তু তার তথ্য যাচাই করতে গিয়ে অবাক হয়ে যান সেখানকার দায়িত্বরত ব্যক্তি। তিনি জানতে পারেন তার পাসপোর্ট অন্য কারও পরিচয়ে করা হয়েছে।

আকাশ রাজী বলেন, ‘অপারেটরের কাছে আমার কাগজপত্র দিয়ে ছবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন তিনি বলছেন জন্মনিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট করেছেন কেন। আর এটা কার জন্মনিবন্ধন। আমি তার কথায় বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে সাদিকুর রহমান নামে এক ব্যক্তির তথ্য আসছে আমার পাসপোর্টে। এমন ভুলের বিষয়টি আমি আগে জানতে পারিনি। জানার পর বিষয়টি সমাধানের কোনো উপায়ও পাচ্ছিলাম না, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জানাতে পারছিলেন না কী করতে হবে। এরপর প্রায় এক মাস আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে বারবার গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তি পেতে হয়েছে।’

তবে এমন ভুলের কথা অস্বীকার করেন উপপরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এটা কখনো হবে না। এখানে আমাদের কোনো ভুল করার কারণ নেই। আবেদনকারী ফরম যেটা পূরণ করবে সেটা আর এনআইডি থেকে ডেটা আসবে সেটাই আমরা ব্যবহার করি। তিনি (আকাশ রাজী) নিজে এমআরপি ফরম পূরণ করে আমাদের দিয়েছেন। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে পাসপোর্ট পেয়েছেন। তাহলে এ সময়ের মধ্যে তিনি জানলেন না কেন? অন্যের তথ্য দিয়ে এটা সে উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছেন।’

পাসপোর্টে আবেদনের ক্ষেত্রে অনেকেই ভুলে করে থাকেন। কিন্তু আবেদনে সঠিক তথ্য দিয়েও ভুল পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য মানুষের। তারা আকাশ রাজীর মতো কর্তৃপক্ষের করা বিভিন্ন ধরনের ভুলের ভোগান্তিতে পড়ছে। তাদের অধিকাংশই জানিয়েছে নাম ও পিতা-মাতার নামের বানানে ভুলের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পিয়াস মন্ডল কর্তৃপক্ষের এমন ভুলের অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৭ সালের দিকে আগারগাঁও অফিসে পাসপোর্ট করি (এমআরপি)। তখন পাসপোর্টের আবেদনে নামসহ অন্যসব তথ্য সঠিকভাবে দিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে দেখি আমার নামে ভুল এসেছে। ইংরেজিতে পিয়াস মন্ডল শেষের ‘এল’ বাদ পড়েছে।’

পিয়াস আরও বলেন, ‘এই পাসপোর্ট নিয়ে আমি ভারতে ঘুরে এসেছি। সংশোধন করতে গিয়ে আমি ভোগান্তিতে পড়িনি। ওই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত বছর নতুন ই-পাসপোর্ট নিয়েছি। সেখানে নামের বানান সঠিক পেয়েছি।’

এদিকে পাসপোর্ট আইনে বা অধ্যাদেশের কোথাও কর্র্তৃপক্ষের ভুলে গ্রাহক হয়রানির জন্য আইনি কোনো ব্যাখ্যা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মনজিলা সুলতানা ঝুমা। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের ভুলে অথবা অবহেলার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির ব্যাপারটা সবসময় ভুল হবে তা কিন্তু নয়। দেখা যায় একটা ভুলের কারণে নতুন করে আবার তথ্য দেওয়া প্রয়োজন হয়। অনেকেই এ ঝামেলায় যেতে চায় না, অফিসে কোনো কর্মচারী তখন বলে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে যান আমি ঠিকঠাক করে দেব। এটা মূলত একটা সিন্ডিকেট। হলফনামা থেকে শুরু করে পরবর্তী সব ডকুমেন্টস ঠিকঠাক হবে শুধু কিছু টাকার বিনিময়ে।’

ঢাকা ও খাগড়াছড়ির জেলা এবং দায়রা জজ আদালতের এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘কারও কাছে যদি প্রমাণাদি থাকে তিনি সঠিক তথ্য দেওয়ার পরও ভুল আসছে, তখন তিনি পাসপোর্ট অফিসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করতে পারেন। জবাবদিহিতা না থাকার কারণে পাসপোর্ট অফিসে কর্মচারী অথবা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সাধারণ পাসপোর্ট প্রার্থীর হয়রানি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

এদিকে কর্তৃপক্ষের ভুল সংশোধনে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে বাড়তি জটিলতার কথা জানাচ্ছেন অনেক ভুক্তভোগী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বাসিন্দা মো. আল-আমিন। এজন্য তিনি পাসপোর্ট নিয়েছেন। তবে সঠিক তথ্য দেওয়ার পরও তার পাসপোর্টে জন্ম তারিখ ১৯৯৬ ভুল হয়ে ১৯৮৬ এসেছে।

আল-আমিনের ভাই ওমানপ্রবাসী মোহাম্মদ ইয়ামিন মিয়া বলেন, ‘পাসপোর্টের এ ভুলের কারণে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় আছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাসপোর্ট অফিস গিয়ে এ সমস্যা নিয়ে কথা বলারই সুযোগ নেই। একমাত্র দালালের মাধ্যমে কাজ করা যায়। জন্মতারিখ সংশোধন নিয়ে আমরা দালালদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছেন, জন্মতারিখ সংশোধন করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে।’

রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দালালচক্রের এমন কার্যক্রমের তথ্য পাওয়া যায়। গত মাসে সরেজমিনে পাসপোর্ট অফিসের সামনে গিয়ে এমন অসংখ্য অসাধু ব্যক্তির দেখা মেলে। তাদের একজন নুরুজ্জামান জানান, পাসপোর্টের সব সমস্যার সমাধান তার মাধ্যমে করা যায়। তার বিভিন্ন মাধ্যম টাকার বিনিময়ে এসব কাজ করে দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আল-আমিনের মতো ভুল হওয়া জন্মতারিখ সংশোধন করা যাবে কি না, জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, ‘এ ভুল সংশোধন করতে ৪০ হাজার টাকা লাগবে।’

এসব বিষয়ে জানতে গত ১১ আগস্ট (শুক্রবার) ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নূরুল আনোয়ারকে ফোন ও মেসেজ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।