কোথায় আছে বাংলা বা বাঙালির ঐতিহ্য – প্রশান্ত দাস কথা

প্রকাশিত: ৩:১৫ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩

রির্পোটিং : বাংলা বা বাঙালির ঐতিহ্য নিয়ে কিছু বলার আগে আমাদের ভেবে দেখা দরকার আমরা সে অর্থে কতটা বাংলা বা বাঙালিয়ানাকে ধারণ করি। বাংলা বা বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য কী? বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূল পটভূমি গ্রাম। গ্রাম বাংলায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ভান্ডারে রয়েছে- হাতে তৈরি মাটির টেপা পুতুল, কাপড়ের পুতুল, কাঠ, পাট ও শোলার বিভিন্ন পুতুল আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। একসময় বাংলার তাঁতীরা বিভিন্ন ধরনের মসলিন তৈরি করতেন। দেশজ জামদানি ছাড়াও খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে ঢাকার মসলিন রোমে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এগুলোর মধ্যে তানজেব, সারবন্দ, বাদান, খোশ, এলেবেলে, তারাঙ্গম, কুমিশ, তূর্য, ননসুখ, মলমল, জামদানি ও আদ্দি অন্যতম।

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের মধ্যে খেলা হতো হাডুডু, নৌকা বাইচ, বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নুনতা, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি,  মোগল-পাঠান, এক্কাদোক্কা, বউরাণী, কড়িখেলা, ঘুঁটিখেলা, কানামছি, ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতর উড়ানো, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি। যুগ যুগ ধরে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হতো নকশিকাঁথা।

পাটজাত পণ্য পাটের তেরি বিভিন্ন রকমের সিকা, শতরঞ্জি, কার্পেট, সৌখিন হ্যান্ডব্যাগ, থলে ইত্যাদি সৌখিন পণ্যরূপে সমাদর পাচ্ছে। শীতলপাটি নকশা করা শীতলপাটিকে নকশিপাটিও বলে। সিলেট এই পাটির জন্য বিখ্যাত। কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকায় বাঁশ ও বেত দিয়ে বেড়া, চাটাই, মাছধরার ফাঁদ, হাতপাখা, মোড়া, ফুলদানি, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি হয়। ঢাকার ধামরাই, সাভার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুরের ইসলামপুর, রংপুর, টাঙ্গাইল ও শরিয়তপুরে বংশ পরম্পরায় তৈরি হয়ে আসছে কাঁসা ও পিতলের জিনিস।

লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই একটি অংশ নকশি পিঠা ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদিদির থলে প্রভৃতি ছাড়াও ধাঁধামূলক ও নীতিকথামূলক গল্পই লোককাহিনী। এসব লোককথা, রূপকথা, ব্রতকথা, কিংবদন্তি ও  লোকপুরাণ মিলে লোককাহিনীর বিশাল ভান্ডার থেকেই তৈরি হয় লোকনাট্য। গ্রামবাংলার অন্যতম বিনোদনের আকর্ষণ ছিলো পুতুল নাচ। বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত ধরনের লোকসঙ্গীতের প্রচলন রয়েছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালি,  ভাওয়াইয়া,  মুর্শিদি,  মারফতি, বাউল,  গম্ভীরা. কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর,  বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন,  বারমাসি, ধামালি,  পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা, গীত প্রভৃতি। খনার বচন যুগ-যুগান্তর ধরে গ্রাম বাংলার জন জীবনের সঙ্গে মিশে রয়েছে। কোনো কাজে উৎসাহ বাড়াতে ও চিত্তবিনোদনের জন্য অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে মুখে মুখে ছড়া তৈরি হতো।

দুর্গাপূজা ও অন্যান্য পূজাতে পরবে ভক্তি অঞ্জলি আলিঙ্গন, উৎসব, কীর্তন, তুলসীমঞ্চ, যাত্রা, নাটক, লালন গম্ভীরা চৌ লোকগীতি ভাটিয়ালি ইত্যাদি গান, রবীন্দ্রনাথ শরৎ থেকে শুরু করে বিপুল সাহিত্যসম্ভার, বিজ্ঞান চর্চা, পরচর্চা গসিপ, হাত পা ছড়িয়ে কথা বলা।<এইসব ঐতিহ্যের বাঙালি চর্চা কতটা সরে গেছে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমত দুর্গাপূজা ও অন্যান্য পূজোতে পরবে শ্রদ্ধা ভক্তি ও অঞ্জলি ঈদে কোলাকুলি উধাও হতে চলেছে বিশেষ করে করোনা মহামারি বাংলা বাঙালির ঐতিহ্য ভুলে বেশ সহায়ক। শুধু পূজো নয় নানান কারণে অকারণে বিকারণে ডিজে সহযোগে যে মাইকাসুর চলে তাতে মনে হয় বাঙালি কি সত্যিই গান ভালোবাসে? নাকি তা কেবল বাঙালির হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার জন্যে গাওয়া হয়েছে? দিন নেই রাত নেই মাইকাসুর উপস্থিত। এবার আসা যাক উৎসব। বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এত উৎসব আছে বলে তো মনে হয় না। কথায় আছে বারো মাসে তের পার্বণ। সারা বছর নানা রকমের আয়োজনে মাতোয়ারা থাকে বাঙালি। সেইসাথে বিয়ে অন্নপ্রাশন জন্মদিন শ্রাদ্ধ এবং মেলা উদযাপন ইত্যাদি লেগেই আছে। আর সব কিছুর সাথে যুক্ত লাউড স্পিকার। কেননা বাঙালির ঠুনকো ভাবনায় ক্রমে গম্ভীর জীবনযাত্রা ঢুকে পড়েছে। চায়ের দোকানে আর সেই আলোচনা নেই। সবাই সতর্ক। এ পাড়ার বৌদি ও পাড়ায় পিসির সাথে কুচকাচালি পরচর্চা অথবা পরনিন্দা সেভাবে আর প্রাণ খুলে হয় না। কেননা প্রত্যেকের মধ্যে বিদেশি চর্চায় নিজের সংসার এবং শুধু নিজের নিজের গুছিয়ে নেওয়ার ভাবনা ঢুকে পড়েছে। বিয়ের আসরে যে আত্মীয়তার বাঁধনে খুঁনসুটিগুলো ছিল তাতেও এসে পড়েছে সতর্কতা। স্বার্থের এত সতর্কতা বাঙালি মানসিকতায় আদৌ ছিল না। পুরান পাঁচালি লোক আখ্যানের সাথে সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে ও সাহিত্যে বিজ্ঞানে শিক্ষায় মননশীলতায় যে বাঙালির পরিচয় পাই বর্তমানের বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে যার কোনো মিল নেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফাস্টফুডের সারি সারি দোকান দেখে মনে পড়ে যায় এখন আর কোনো অনুষ্ঠানে বাঙালির অন্ন ব্যঞ্জন আর চোখে পড়বে না। বিভিন্ন বিদেশিয়ানী পদে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। বাঙালী গৃহস্থ আজ নিজে নিজেই ভাবছে ‘ছি ছি, এই হলো বাঙালি।’ কবির কথায় ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নি?’ ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর কোট টাই-এর দৌলতে বাংলা ভাষা এমনিতেই অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে। গুড মর্নিং আর গুড নাইটের দৌরাত্ম্যে ‘কেমন আছো?’ সালাম নিবেন বা নমস্কার এ জাতীয় হৃদয় কথা হারিয়ে যেতে বসেছে। এত সবের ভিড়ও কিছু সৃষ্টিশীল সুশিল সমাজের ব্যাক্তি তার মননশীলতা চিন্তা-চেতনায় বাঙালির ছাপ রাখছে। বাঙালি ঐতিহ্য যদিও তার থেকে অনেকটাই সরে যাচ্ছে। তবে আশার কথা পাড়া-মহল্লায় আজও বাঙালিয়ানা আছে। তার  সেই ঐতিহ্যের আবহমান প্রবাহিত হবে পুরো বাংলা। সুরক্ষিত হোক বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য। প্রশান্ত দাস কথা : সাংবাদিক ও উপস্থাপক।