ফিলিস্তিনের উপর হামলা” বিশ্ব মানবাধিকার কোথায় ?

প্রকাশিত: ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১, ২০২৩

রিপোর্টিং : বিশ্ব শক্তির সহযোগিতায় ইসরায়েল কর্তৃক সংগঠিত দখল-হত্যা ও নিষ্ঠুরতার যেন পৃথিবীর সব অপরাধ কে হার মানিয়েছে। গত কয়েক দিনে ইসরায়েল কয়েক হাজার টন বোমা বর্ষণে, শিশু-নারী-যুবক-বৃদ্ধ হাজারো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাড়ি-ঘর ,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স কিছুই রক্ষা পায়নি। ইসরায়েলি বোমায় ক্ষতবিক্ষত সাদা কাপড়ে মোড়ানো ফিলিস্তিনি শিশুর ছবি বা আত্মচিৎকারেও কি জাগবে না বিশ্ব বিবেক?

মানবিক বিপর্যয়,মানবাধিকারও কি নির্ধারিত হবে ধর্ম-বর্ণের আবরণে? এখন কেন বিশ্ব মানবাতা নিরব। কোথায় বিশ্ব মানবাধিকার? তাহলে বিশ্ব মানবাধিকার কার জন্য ? শুধু দুর্বলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এলাকা গাজায় মাত্র ১৪০ বর্গমাইলের মধ্যে ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। সেই এলাকায় চলছে বৃষ্টিরমত বোমা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক ভবন। নিজেদের উপর সহসা নেমে আসা এই দুর্যোগে প্রাণ বাঁচাতে কোথাও এমনকি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও নেই গাজার সাধারণ ফিলিস্তিনিদের।

ফিলিস্তিনিদের ওপর চলছে ইসরাইলের বর্বর হামলা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফিলিস্তিনিকে ঘর থেকে বের করে তার ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারো ভিটে মাটি কারো বা ফসলের জমি কেড়ে নিচ্ছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনিদেরও অভিযোগের শেষ নেই। তারা এখন নিস্ব। নেই তাদের খাবার বস্ত্র,এমন কি পানি খাওয়ার মত কিছুই তাদের নেই। ক্রমেই মাটিতে মিশে যাবে গাজা!

ইসরায়েল উত্তর গাজায় আধা ঘণ্টা সময় দেয় বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই কার্যক্রমকে মানবতাবিরোধী বলে উল্লেখ করেছে। এভাবে জোর করে বাড়ি ত্যাগ করানোর ঘটনা বিরল। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, খুব শিগিগরই গাজায় অভিযান চালানো হবে। গত বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনীর সদস্যদের এক অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত বলেন, এখন আপনারা গাজাকে খুব দূরে দেখছেন, শিগিগরই আপনারা ভেতর থেকে দেখবেন।

উত্তর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সতর্কবার্তার পর বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। তারা জানিয়েছেন, ফিরে এসে হয়তো তারা আর তাদের বাড়ি ফিরে পাবেন না। এই শহরের বাসিন্দারা খুব ভোরে তাদের মোবাইলে ইসরায়েলি বাহিনীর সতর্কবার্তা দেখতে পান। ১০ মিনিট পরেই ড্রোন হামলা হয়। ২০ মিনিটের মাথায় এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে কয়েকটি ভবন গুঁড়িয়ে দেয় নেতানিয়াহুর বাহিনী। গাজার এক তৃতীয়াংশ তথা ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি বাড়ি ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৩ হাজারের বেশি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল এই প্রথম গাজায় তিন ধাপের সামরিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, আইডিএফ হামাসের বিরুদ্ধে স্থল ও আকাশ পথে তিন ধাপে লড়াই চালাবে। তিনি বলেন, এই লড়াই শেষে গাজায় সাধারণ মানুষের জীবনের দায়িত্ব নেবে ইসরায়েল। কিন্ত আমি বলবো সব মেরে শেষ করে দিলে তারা কাদের দায়ীত্ব নিতে চায়? পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলা এটা কি ঠিক করেছে? ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষের ওপর ইসরাইলি সামরিক বাহিনী তারা যেভাবে বিমান হামলা চালাচ্ছে, এতে প্রাণহানি ঘটছে, মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। ফিলিস্তিনি শিশুদের পাথরের জবাবে ইসরাইলি বাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে। বোমা বর্ষণ করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। এটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। মসজিদের পর এবার বৃহস্পতিবার রাতে গাজা উপত্যকার একটি গির্জায় ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে।

গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ঘরহারা মানুষদের অনেকে ওই গির্জায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এটা কি বিশ্ব মানবিধার দেখেন না। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলি কি করে। তাদের কাজ কি? এছাড়া মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদে আকসা ইসরায়েল দখল করতে চায়। এত কিছুর পরও বিশ্ব মানবাধিকার এখন যেন ঘুমিয়ে সময় পার করছে। মার্কিন ‘মানবাধিকার নীতির’ মুখোশ খুলে দিয়েছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বুধবার ইসরায়েল সফরে গিয়ে তাদের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানালেন। এটা কি একজন বিশ্ব নেতার দায়িত্ব। আসলে তারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। আমি মনে করি একদিন এর খেশারত দিতে হবে তাদের। ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে এমন গলার কাঁটা করে রাখা হয়েছে যাকে না পারছেন তুলতে না পারছেন গিলতে।

ইসরাইলের জুলুম নির্যাতন থেকে ফিলিস্তিনি নিরীহ মানুষকে বাঁচানোর এক মাত্র উপায় সারা মুসলিম বিশ্বের এক কাতারে সামিল হওয়া। এদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মঙ্গলবার বলেছেন, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সহিংসতার ঢেউ মার্কিন নীতির ব্যর্থতার প্রমাণ। তারা ফিলিস্তিনি স্বার্থ উপেক্ষা করে একচেটিয়া আলোচনার চেষ্টা করেছিল। অপরদিকে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর ইরানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিনের ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন নিজেদের নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। তবে দেশটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে।

সৌদি আরবের অঘোষিত শাসক ক্রাউন প্রিন্স যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন থাকার কথা জানিয়েছেন। ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাজ্যের অবিচল সমর্থনের কথা জানিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তুরস্ক সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতার আগ্রহ দেখিয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজায় রক্তপাতের জন্য এবং ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সাথে বিরোধ ঘনীভূত করার পেছনে ইসরায়েলকে ‌দায়ী করেছে উত্তর কোরিয়া। ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে গাজায় ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাত বাড়িয়ে তোলার জন্য এবং চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য এককভাবে ইসরায়েলকে দোষারোপ করেছে কাতার এবং কুয়েত। সহিংসতার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে মিশর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কি বিশ্ব যুদ্ধের অসংখ্যা ? অবশ্যই ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ বন্ধে মিসরের রাজধানী কায়রোয় শুরু হয়েছে শান্তি সম্মেলন।

ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বেশ কয়েকজন নেতা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন,’ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন,আমরা কখনই স্থানান্তর মেনে নেব না, যত চ্যালেঞ্জই হোক না কেন আমরা আমাদের ভূমিতেই থাকব। কায়রোতে শুরু হওয়া শান্তি সম্মেলন জর্ডান,কাতার, ইতালি, স্পেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। তবে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের কোনো প্রতিনিধি সেখানে নেই। আমার মনে হয় আলোচনার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের মেরে সাফ করে দিবে ইসরায়েল।

একসময় যেটা ফিলিস্তিনিদের ভূমি ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা ১৯৪৮ সালে সেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের পরাজিত করে ইসরায়েল বিস্তৃত এলাকা দখল করে নেয়। ১৭ বছর ধরে গাজা অবরুদ্ধ,পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা কারাগার। ২০০৫ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনিদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহমুদ আব্বাস। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর আল ফাত্তাহর নেতৃত্বে আসেন মাহমুদ আব্বাস। ২০০৬ সালের প্রাথমিক নির্বাচনে পরাজিত হয় ফাত্তাহ। সেই বছরই হামাস-ফাত্তাহ গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয় ফাত্তাহ।

২০০৭ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গাজায় সরকার গঠন করে হামাস। গাজার এক পাশে ভূমধ্যসাগর, এক পাশে মিশর এবং দুই পাশে দখলদার ইসরায়েল। ৪১ কিলোমিটার লম্বা ও ১০ কিলোমিটার প্রস্থের গাজা উপত্যকায় প্রায় ২৩-২৪ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস, যাদের ৭০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে ও বেকারত্বের হার ৬৫ শতাংশ। হামাস ক্ষমতায় আসার পর ২০০৭ সাল থেকে মিশর ও ইসরায়েল গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এখানে কী ঢুকবে, আর কী ঢুকবে না তা নিয়ন্ত্রণ করে মিশর ও ইসরায়েল। এটাও কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। মানুষের মৌলিক অধিকর থেকে বঞ্চিত ফিলিস্তিরা তাহলে জাতিসংঘের প্রয়োজন কি।ইসরায়েলে হামাসের হামলা ও এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে চলছে ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণা। এর মধ্যে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনবিরোধী মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

ভারতের মূলধারার অনেক গণমাধ্যমও এ থেকে মুক্ত নয়। মিথ্যা তথ্যের খনি হয়ে উঠেছে এক্স (সাবেক টুইটার)।ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারে নেমেছে এমন বেশ কিছু ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করছে ভারতের নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান বুম। আসলে ভারত কি এটা ঠিক করছে। আমার মনে সকলে এখন মুসলিমদের শত্রুতে পরিনত হয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের রক্ষা করতে হবে।

-আওরঙ্গজেব কামাল লেখক ও গবেষক